স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ ও করণীয়: ডা. মো. হাবিবুল্লাহ
প্রকাশিত : ১৩:০২, ৩ নভেম্বর ২০১৮
ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে সারাবিশ্বে স্তন ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়, শীর্ষে রয়েছে ফুঁসফুঁস ক্যান্সার। আর নারীদের মৃত্যুর কারণ হিসাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে স্তনের ক্যান্সারই রয়েছে শীর্ষস্থানে।
গোটা দুনিয়ায় ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে অধিকাংশই আক্রান্ত হন স্তনের ক্যান্সারে। আক্রান্তের হার বছরে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৮০জন।
আনুমানিক বিশ্বে ১০,৫০,০০০ এর বেশি নারী প্রতি বছর নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৫,৮০,০০০ নারী উন্নত দেশগুলোর, বাকিরা আক্রান্ত হন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
স্তন ক্যান্সার কি?
শরীরের অন্যান্য স্থানের মত স্তনে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির ফলে কোনো চাকা বা পিন্ডের সৃষ্টি হলে তাকে টিউমার বলে। শরীরের বিনা প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন থেকে এর সৃষ্টি। প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্তনের টিউমার দুই ধরনের-
আরো পড়ুন : জরায়ু ক্যান্সার বুঝার উপায় ও এর সঠিক চিকিৎসা কী?
১. বিনাইন টিউমার অক্ষতিকার টিউমার। উত্পত্তি স্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দূরের বা কাছের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে না।
২. ম্যালিগন্যান্ট টিউমার আগ্রাসী, ক্ষতিকারক টিউমার। উত্পত্তি স্থলের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে কিংবা গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে। এমনকি রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে দূরের কোনো অঙ্গেও আঘাত হানতে পারে। স্তনের ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই স্তন ক্যান্সার।
স্তন্য ক্যান্সার সাধারণত স্তনের দুধবাহী নালীতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য টিস্যু থেকেও শুরু হতে পারে। একটি পিন্ড বা চাকা হিসেবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রথম ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে বড় হয় এবং শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরো পড়ুন : স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের ঘরোয়া পদ্ধতি: ডা. মো. হাবিবুল্লাহ
স্তনের সঙ্গে নিকটস্থ বগলতলার লসিকাগ্রন্থি বা গ্ল্যান্ডগুলোর খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় এগুলোতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ
স্তনের চাকা বা পিন্ড স্তনের বোঁটা বা নিপল ভিতরে ঢুকে যাওয়া, অসমান বা বাঁকা হয়ে যাওয়া;
স্তন্যের বোঁটা দিয়ে অস্বাভাবিক রস বা রক্তক্ষরণ হওয়া;
চামড়ার রঙ বা চেহারায় পরিবর্তন;
বগলতলায় পিন্ড বা চাকা হওয়া;
প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয়-
দুটি উপায়ে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব
১. স্তন ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে জরুরিভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা।
২. যাদের লক্ষণ নেই, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের রোগী সনাক্ত করা। স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং-এর জন্য রয়েছে প্রধান তিনটি পদ্ধতি। যথা-ম্যামোগ্রাম, ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন ও ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন।
ম্যামোগ্রাম
ধনী দেশগুলোতে স্তন্য ক্যান্সার স্ক্রিনিং-এর জন্য প্রধানত ম্যামোগ্রাম বেছে নেওয়া হয়। নির্ধারিত বয়স সীমার (সাধারণত: ৫০ বছরের বেশি) নারীদের নির্ধারিত বিরতিতে এক, দুই বা তিন বছর পরপর নিয়মিতভাবে ম্যামোগ্রাম করা হয়।
এটি একটি বিশেষ ধরণের এক্স-রে, যার মাধ্যমে স্তনে খুব ছোট চাকা বা অন্যান্য পরিবর্তন ধরা পড়ে। এই পদ্ধতি তুলনামুলকভাবে ব্যয়বহুল এবং খুব সহজলভ্য নয় বলে উন্নয়নশীল দেশে অন্য পদ্ধতিগুলোর উপর জোর দেয়া হয়।
ব্রেস্ট এক্সামিনেশন
চিকিৎসক অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দিয়ে স্তন্য পরীক্ষা করে নেওয়া। চিকিত্সক স্তন এবং বগলতলায় কোন চাকা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন আছে কিনা তা সযত্নে পরীক্ষা করে দেখবেন।
ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন
একজন নারী নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নিজেই নিজের স্তন্য পরীক্ষা করবেন। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে যদি নিয়মিতভাবে নিজের স্তন ভালোভাবে পরীক্ষা করেন তাহলে যেকোনো ধরণের অসামাঞ্জস্য ও পরিবর্তন নিজেই প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন।
সুতরাং ২০ বছর বয়স থেকে সারা জীবন প্রতি মাসে একবার নিজেই নিজের স্তন্য পরীক্ষা করুন। অস্বাভাবিক কোন পরিবর্তন আপনার কাছে ধরা পড়লে চিকিৎসক অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে স্তন্য পরীক্ষা করুন। চিকিৎসক যদি কোন চাকা বা পিন্ড অথবা অন্য কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন সনাক্ত করেন তবে পরামর্শ মত ম্যামোগ্রাম, স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম অথবা অন্যান্য পরীক্ষা করুন। মনে রাখবেন প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার সনাক্ত হলে নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।
লেখক : ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট।
টিআর/